মারমা লোকগল্প ।। আপ্যায়াং
পাহাড় থেকে দূরের কোন এক গ্রামে এক অলস ব্যক্তি বাস করতো। নাম ছিলো তার আপ্যায়াৎ। সারা বছরে গোসল করতো মাত্র দুর্দিন। সেটাও এমন যে, রিং পোর্ট্রে’র দিনে প্রতিবেশিরা এসে যদি পানি ছিটিয়ে দিলো তো একটা দিন গোসল হয়ে যায়। আবার কোন একদিন যদি কোনভাবে ঝর্ণার কাছে যেতে হয়তো সেখানেও আশপাশের লোকেরা জোর করে ধরে পানিতে চুবিয়ে দেয়। এই দুই ক্ষেত্রেই সে ঘরে ফিরে প্রতিবেশিদের গোষ্ঠি উদ্ধার করে গালমন্দ করতে থাকে। এমনকি বিছানা থেকে উঠ বসে ভাত খেতেও আলস্য লাগে তার। হঠাৎ একদিন তার খুব আম খেতে ইচ্ছে করলো। কিন্তু সে এতোই অলস ছিলো যে, নিজে গাছে উঠে একটা আম পেড়ে খাবে এমন পরিশ্রম সে করতে পারবে না। এমন অবস্থায় সে খুব চিন্তায় পড়ে গেলো। বিছানায় শুয়ে শুয়ে সে ভাবে, কি করে বিছানায় শুয়ে শুয়ে আম খাওয়া যায়। ভাবতে ভাবতেই তার দিনের পর দিন কেটে যেতে লাগলো, কিন্তু আম আর তার খাওয়া হয় না। এভাবে তো আর পারা যায় না, একদিন ঘুম থেকে উঠে হাঁটতে হাঁটতে সে পাহাড়ে গেলো। পাহাড়ে গিয়ে দেখলো, পাহাড়ের গায়ে খুব সুন্দর একটি আম গাছ। গাছভর্তি পাকা আম। দেখেই তার জিভে জল এসে গেলো। গাছভর্তি পাকা আম থাকলে কি হবে, গাছে উঠে আম পাড়া অনেক কষ্টের কাজ। সে এতো অলস যে এইটুকু পরিশ্রম সে করতে পারবে না। গাছের নিচে বসে ভাবতে লাগলো কি করে বিনা পরিশ্রমে পাকা আম খাওয়া যায়। হঠাৎ তার মাথায় এলো, গাছের নিচে যদি হা করে শুয়ে থাকে তাহলে এমনিতেই পাকা আম তার মুখে এসে পড়বে, তাহলে এতো কষ্ট করে আম পেরে খাওয়ার কি দরকার আছে। যেই ভাবা সেই কাজ, সাথে সাথে সে মুখটা হা করে শুয়ে পড়লো সেই গাছের নিচে। একটু পর পর বাতাসে দোল খেয়ে একটা-দুইটা করে পাকা আম পড়তে লাগলো, কিন্তু সবই এদিক-ওদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। একটা আমও তার মুখ বরাবর এসে পড়লো না। সে-ও আর কষ্ট করে উঠে এদিক-ওদিক থেকে আম কুড়িয়ে খেলো না। আলসেমি করে মুখটা হা করে রেখে চোখ বুজে পরে থাকলো ঘাসের বিছানায়। কিন্তু আর কতক্ষণ। বেলা শেষ হয়ে যাচ্ছে- অথচ তার মুখের মধ্যে আম পড়ার নাম নেই। ক্ষুধায়ও ক্লান্তি এসে গেলো, একসময় রেগে গেলো সে। আস্তে আস্তে উঠে, কোন রকমে বসলো। এদিক ওদিকে মাটিতে পড়ে থাকা আমগুলির থেকে সুন্দর একটা আম হাতে নিয়ে নিজের অণ্ডকোষে ঘষে ছরায় ফেলে দিলো। রাগের মাথায় পুরো আমগাছসুদ্ধ গলিগালাজ করে আপ্যায়াং ঘরে ফিরে এলো।
একই গ্রামে বাস করতেন সেই অঞ্চলের রাজা। রাজার ছিলো দুই কন্যা। রাজকন্যাদ্বয় এতো রূপসী ছিলো যে, তারা রাস্তায় বের হলে রাস্তার দুই পাশে লোক দাঁড়িয়ে থাকতো শুধু মাত্র রাজকন্যাদের রূপ দেখার জন্য। একদিন রাজার দুই কন্যার মাছ ধরতে ইচ্ছা করলো। পাহাড়ি অঞ্চলে পুকুর কাটা কিছুতেই সম্ভব ছিলো না। জল ও মাছের একমাত্র উৎস ছিলো ঐ গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ছোট্ট একটি পাহাড়ি ঘরা। তো, রাজা তার কন্যাদের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা খুঁজে না পেয়ে শেষ পর্যন্ত ছরাতে মাছ ধরতে যাওয়ার অনুমতি দিলেন। তার অপরূপ সুন্দরী কন্যাদ্বয় বাবার অনুমতি পেয়ে মহানন্দে মাছ ধরতে গেলো ছরায়। ছরায় মাছ ধরতে ধরতে ছোট রাজকন্যা দেখলো, তার যাক সেঃ’তে মাছের সাথে সাথে টসটসে একটি পাকা আমও উঠে এসেছে। এমনিতেই তখন দুপুর পার হয়ে গেছে। ক্ষুধায় তাদের পেট চোঁ-টো করছিলো। তার উপর এমন সুন্দর পাকা আম দেখে ছোট রাজকন্যার ক্ষুধা আরও দ্বিগুণ হয়ে গেলো। আমটা হাতে নিয়ে সে ভাবলো, একটা মাত্র আম, দিদিকে জানাবে কি-না। আনালে তো, দিদিকেও ভাগ দিতে হবে। এই ভেবে সে আর তার দিদিকে জানালো না। সে তার যাক সে জলে পেতে রেখে একা একা ঝোপের আড়ালে গিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে আমটা মজা করে খেয়ে নিলো। এতো সুমিষ্ট আমের স্বাদ তার ঠোঁটে-জিহ্বায় লেগে থাকলো। এমনকি হাতে লেগে থাকা রস পর্যন্ত চেটেপুটে খেয়ে বেরিয়ে এলো ঝোপের আড়াল থেকে। এদিকে ছোট বোনকে দেখতে না পেয়ে খুঁজতে শুরু করে দিয়েছে তার বড় দিদি। ছোট বোনকে দেখতে পেয়ে দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো। ক্ষুধা আর অঘটনের ভয়ে তারা মাছ ধরা বন্ধ করে ফিরে এলো দুলা ভর্তি মাছ নিয়ে রাজামশায় কন্যাদের ধরা মাছ দেখে খুব খুশি হলেন। তিনি ভাবলেন, কন্যাদ্বয় তার মতোই যোগ্য হয়ে উঠেছে।
এরপর কিছুদিন যেতে না যেতেই তাদের মা টের পেলো, তাদের আদরের ছোট কন্যা গর্ভবর্তী। অল্প সময়ের মধ্যেই এই খবর রাজার কানে গেলো। ছোট রাজকন্যা গর্ভবতী হয়েছে শুনে রাজা খুব লজ্জায় পড়ে গেলেন। মনে হলো, তার মুখের উপর গ্রামবাসীরা থুথু ফেলে আবার পা দিয়ে মুছে দিয়েছে। লজ্জায় অপমানে রাজা প্রায় পাগল হয়ে গেলেন। রাগে-দুঃখে রাজা তার সৈন্যদের ডেকে আদেশ দিলেন, “কার এতো বড় সাহস, যে ছোট রাজকন্যার সাথে এই অন্যায় কাজ করেছে? আমি তার মুখখানা দেখতে চাই। যাও, সাড়া আম তছনছ করে হলেও ছেলেটাকে আমার কাছে ধরে আনো সাথে সাথে সৈন্যরা নেমে পড়লো সেই ছেলেকে খুঁজতে। ঝাড়-জঙ্গল, সারা পাহাড়-সাম তছনছ করে খুঁজতে লাগলো। কিন্তু, খুঁজবে কি করে? কেউ তো আর জানে না যে, কে এমন কাজ করেছে। আবার জনে জনে জিজ্ঞেসও করা যায় না। তারা ব্যর্থ হয়ে ফিরে এলে রাজা আবার ধমক দিয়ে পাঠিয়ে দেয়, “আমি কিচ্ছু শুনতে চাই না। যাও, যেভাবে পারো, যেখান থেকে পারো ধরে নিয়ে আসো।”
রাজার হুকুম পেয়ে সৈন্যরা আবার ছুটে যায়। এইভাবে অনেক চেষ্টার পর অবশেষে সৈন্যরা আপ্যায়াংয়ের কাছে এসে দেখলো, একটা অলস ছেলে, যে কোন কাজকর্ম করে না আবার রাজাকেও কোন রকম কর দিতে পারে না। রাজ্যে এমন এক অলস আছে দেখে সৈন্যরা খুব বিরক্ত হলো, আবার অন্যায়কারী ছেলেটাকেও খুঁজে না পেয়ে দিনরাত রাজার ভর্ৎসনাও শুনতে হচ্ছে। সৈন্যরা ভাবলো, এমন অলস ছেলেকে যদি ধরে নিয়ে যায় তবে রাজার হুকুমও পালন করা হবে আবার রাজ্য থেকে একটা অলস ব্যক্তিও কমবে, এতে করে সবার মঙ্গলই হবে। যেই ভাবা সেই কাজ। তারা আপ্যায়াংকে ধরে নিয়ে এলো রাজার কাছে। রাজা আপ্যায়াংয়ের সমস্ত কথা শুনে খুব হতাশ হলো। এই ছেলে তো ভয়ানক রকমের অলস, যে নিজের খাবারটা পর্যন্ত নিজের হাত দিয়ে মুখে তুলে খেতে চায় না, তার সাথে কি করে আদরের রাজকন্যার বিয়ে দেবে। আবার সময় থাকতে বিয়েটা দিতে না পারলেও মানসম্মান আর কিছু বাকি থাকবে না। রাগে দুঃখে দুজনকেই কেটে নদীতে ভাসিয়ে দিয়ে ইচ্ছা করছে রাজার। তিনি গজগজ করতে করতে পায়চারি করছিলেন। হ্যাঁ, নদীতেই ভাসিয়ে দিতে হবে এই দুটোকে। ভাবতে ভাবতেই তার মাথায় ঢুকলো, না কেটেও তো নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া যায়। রাজা ভাবলো, হ্যাঁ, তাই করবো। এই দুইটাকে বিয়ে দিয়ে ভেলায় করে নদীতে ভাসিয়ে দেবো। ওরা ওদের মতো সংসার করুক। বুঝুক, জীবন কত কঠিন, এটাই ওদের উপযুক্ত শান্তি।
অতঃপর রাজা ধুমধাম করে আপ্যায়াংয়ের সাথে রাজকন্যার বিয়ে দিয়ে দিলো। বিয়েতে বিশটা শূকর কেটে রাজ্যের সমস্ত লোক দাওয়াত করে খাওয়ালো। অনেকদিন পর রাজকন্যার বিয়েতে পেট ভরে মাংস খেয়ে গ্রামবাসী আরামের ঢেঁকুর তুলতে লাগলো। সেইসাথে সকলেই কানাঘুষা করতে লাগলো, “এই রকম একটা অলসের সাথে রাজামশায় কি করে তার ছোট মেয়েকে বিয়ে দিতে পারলো। কিন্তু রাজার সামনে মুখটা খুললো না কেউ, তারা উলটো প্রশংসা করতে লাগলো- যাতে করে খাওয়া থেকে রাজামশায় তাদের তাড়িয়ে না দেয়। খাওয়া শেষে বিয়ে বাড়ি থেকে একে একে সবাই বিদায় নিলো। বিয়ের যাবতীয় অনুষ্ঠান শেষে রাজামশায় রাতের অন্ধকারে বর-বউ দু’জনকে নিয়ে এলো একটি নদীর কিনারায়। নদীর ঘাটে বাঁধা ছিলো একটি ভেলা। আদরের ছোট মেয়েকে ভাসিয়ে দিতে হচ্ছে- এই দুঃখে রাজার চোখে পানি চলে এলো। শেষবারের মতো নিজের মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে আশীর্বাদ করে ভেলায় তুলে দিলো রাজামশায়। নতুন বর-বউসহ নিজের হাতে ভেলাটা নদীর জলে ভাসিয়ে দিলো রাজামশায়। রাতের অন্ধকারে নদীর স্রোতে দিকহীন ভেসে চললো রাজকন্যার ভেলা। আর নদীপাড়ে দাঁড়ানো রাজামশায়ের চোখ ভেসে গেলো। ভেলায় ভাসতে ভাসতে আপ্যায়াং আর রাজকন্যা পড়লো। ঘুমের ঘোরে রাজকন্যা আপ্যায়াংকে জড়িয়ে ধরলো। ঘুমের মধ্যে এক সময় রাজকন্যা টের পেলো তার স্বামীর পাছায় পাটের আঁশের মতো কি যেন জড়িয়ে আছে। সে ধরফর করে ঘুম থেকে উঠে পড়লো। তারপর সামান্য আলো তুলে স্বামীর পাছা ভালো করে খেয়াল করে দেখলো- তার অলস স্বামীর পাছায় অনেক বেশি লোম। যেন সারা জীবনে একবারও সে লোম কাটেনি। আলো নিভিয়ে এবার সে আগের মতোই স্বামীর পাশে শুয়ে পড়লো। তারপর আস্তে আস্তে ঘুমন্ত স্বামীর গায়ে হাত বোলাতে বেলাতে পাছার কাছে হাত নিয়ে আস্তে করে টেনে একটা একটা করে লোম তুলতে লাগলো। একটা করে লোম ধরে টান দেয় আর সাথে সাথে অলস স্বামী কেঁপে ওঠে। তার স্বামী কেঁপে ওঠে আর সে জড়িয়ে ধরে। আবার একটা লোম ধরে টান দেয় আর স্বামী কেঁপে ওঠে আর সে জড়িয়ে ধরে। এইভাবে সারারাতে সে স্বামীর পাছার সমস্ত লোম তুলে পরিষ্কার করে ফেললো। সকাল হতে না হতেই ভেলাটা একটা অচেনা আমের ঘাটে এসে ভিড়ে গেলো। ঘুম থেকে উঠেই আপ্যায়াং দেখলো নদীর ঘাটে আটকে আছে ভেলা। অভ্যেসবসত সে ভাবলো, ঘাটে ভিড়লেই কি আর না ভিড়লেই কি! সে চারপাশ ভালো করে দেখে আবার চোখ বুঝলো। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার। সে আর কিছুতেই শুয়ে থাকতে পারছে না। চোখেও ঘুম নেই। ভেলার উপর উঠে বসলো। তখনো রাজকন্যা ঘুমিয়ে। এবার আর সে বসে থাকতে পারলো না। সে নিজের পাছায় হাত দিয়ে দেখলো, একটা লোমও নেই তার পাছায়। কি করবে করবে ভেবে, রাজকন্যাকে ডেকে তুলে জিজ্ঞেস করলো, “ভেলা ঘাটে ভিড়ে গেছে। এবার আমরা কি করবো?”
রাজকন্যা এবার তাকে নির্দেশ দিলো, “ভেলা থেকে নেমে আমাদের বসতবাড়ি গড়তে হবে।”
যেই কথা সেই কাজ, আপ্যায়াং ভেলা থেকে নেমে রাজকন্যাসহ সমস্ত জিনিস নিজে কাঁধে করে পাড়ে নামালো। তারপর মালামাল কাঁধে আর রাজকন্যাকে এক হাতে নিয়ে গ্রামের দিকে ছুটে গেলো। আমে একটা উপযুক্ত জায়গা বেছে নিয়ে নিজেই গড়লো বসতভিটা। সেই ভিটায় জঙ্গল থেকে কাঠ কেটে এনে ঘর বাঁধলো। রাজকন্যা দেখলো, এই সেই অলস আপ্যায়াং যে এখন একাই এক রাজ্যের কাজকর্ম করে গুছিয়ে ফেলেছে নিজের সংসার। রাজকন্যা কর্মঠ স্বামীকে পেয়ে খুব সুখী হলো। সে-ও স্বামীকে খুব ভালোবাসতে শুরু করলো। দু’জনের সংসার সুখ-সমৃদ্ধিতে ভরে উঠলো।
একদিন ঘুম থেকে উঠে আপ্যায়াং জুম চাষের জন্যে পাহাড়ে গেলো জঙ্গল কাটতে। সারাদিন অনেক পরিশ্রম করে একটু একটু করে জঙ্গল কেটে জুমের জায়গা বানিয়ে ক্লান্ত হয়ে আপ্যায়াং সন্ধ্যায় ঘরে ফিরলো। জঙ্গল কাটার সময় একটা ফ্লু মেরে রেখেছিলো। স্বামীর হাতে ফ্লু দেখে রাজকন্যা আরও বেশি খুশি হলো। ঘরে আসতেই স্বামীর ঘাম মুছিয়ে দিলো রাজকন্যা। তারপর ফ্লু’র মাংস রান্না করে দু’জনে খুব মজা করে খেয়ে ঘুমিয়ে পরলো। পরদিন ঘুম থেকে উঠে এক বাটি পাস্তা খেয়ে আবার জুমে চলে গেলো আপ্যায়াং। জুমে এসে অবাক হয়ে গেলো সে। দুঃখে মাটিতে বসে পরলো আপ্যায়াং। এতো কষ্ট করে যে জঙ্গল কেটে পরিষ্কার করেছিলো, সেই জঙ্গল আবার আগের মতো হয়ে গেছে। হায়, হায়! এটা কি করে সম্ভব। আপ্যায়াং হতাশা আর রাগ নিয়ে আবার জঙ্গল কাটতে লাগলো। সারাদিন জঙ্গল কেটে পরিষ্কার করে আগের দিনের মতোই ঘরে ফিরলো সন্ধ্যায়। পরদিন সকালে জুমে এসে দেখলো একই কাণ্ড। আবারও আগের মতোই জঙ্গল হয়ে গেছে। এইভাবে সে পরপর তিনদিন জঙ্গল কাটলেও, জঙ্গল আবার আগের মতো হয়ে যায়। এবার সে প্রচণ্ড ক্ষেপে গেলো। মাথায় জিদ চেপে গেলো, যে করেই হোক দেখতে হবে রাতে আসলে কি ঘটে, কে তার কষ্টের ফল পরিষ্কার জায়গায় এই জঙ্গল বানিয়ে দিচ্ছে। সে তিনদিনের মাথায় সন্ধ্যেবেলা গেলো জুম পাহারা দিতে। সাথে নিলো একটা দেগ্রী আর একটি ন-না-খাগ। তারপর সে সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে গিয়ে তার পরিষ্কার করা ঘুমের পাশে একটা ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে পড়লো। ঝোপের আড়াল থেকে সে লুকিয়ে লুকিয়ে পাহারা দিতে লাগলো তার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন জুম। হঠাৎ মধ্যরাতে সে দেখলো ঝড়ের মতো বাতাস আর বিকট শব্দ। কিন্তু কাউকে দেখা গেলো না। কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে টের পেয়ে সে একহাতে দা আর এক হাতে ন-না খাগ নিয়ে প্রস্তুত হলো। তারপর বাতাস থেমে গেলো, আওয়াজটাও কমে গেলো। সে দেখতে পেলো বিরাট এক ফুলুমা পরিষ্কার জায়গায় এসে দাঁড়িয়ে পড়লো। চারপাশ ভালো করে দেখে সে হাসতে লাগলো। এরপর সেই ফুলুমা ঘুরে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে কি এক মন্ত্র পড়ছে। আপ্যায়াং মনোযোগ দিয়ে শুনতে চেষ্টা করলো ফুলুমা কি বলে। সে শুনতে পেলো ফুলুমা চিৎকার করে বলছে,
“আপ্যায়াং য়া খোওয়াই, তঁহ খং থং
সইকাঃ ওয়াংগা, প্রং প্রং থং”
ফুলুমার মন্ত্র পড়া শেষ হতে না হতেই পরিষ্কার জুম আবার জঙ্গল হয়ে গেলো। চোখের সামনে এতো পরিশ্রমের জুম জঙ্গল হতে দেখে আপ্যায়াং আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না। সে ধীরে ধীরে পিছন দিক দিয়ে গিয়ে একটা গাছে উঠে ফুলুমার ঘাড়ের উপর লাফিয়ে পড়লো। কাঁধের দুই দিকে দুই পা ঝুলিয়ে বসে প্রথমে ফুলুমার মুখের সামনে ধরলো ন-না-খাগ আর ঘাড়ে ঠেকালো দেগ্রী। ফুলুমা ন-না-খাগ দেখে ভয়ে ছটফট করে উঠলো। সে রীতিমতো চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করলো,
– ও ভাই, কে তুমি? ছেড়ে দাও আমার। ওরে বাবারে, সরাও এই ন-না-খাগ। ফুলুমার ভয় পাওয়া দেখে আপ্যায়াংয়ের সাহস আরও বেড়ে গেলো। হাতের দা দিয়ে ঘাড়ে হালকা করে খোঁচা দিলো। ফুলুমা আরও ভয় পেয়ে গেলো, বাবা গো গেলাম গো। কে তুমি ভাই? বলো আমি তোমার কি ক্ষতি করেছি? আমায় মারছো কেন?
ফুলুমার কথা শুনে এবার আপ্যায়াং বললো,
-আমি রোজ কষ্ট করে জঙ্গল কেটে জুম বানাই আর তুমি কেন সেটা জঙ্গল বানিয়ে দাও?
আপ্যায়াং এর কথা শুনে এবার ফুলুমা বললো,
– ভাই, তুমি তো শুধু তোমার স্বার্থই দেখলে। পাহাড় থেকে জঙ্গল কেটে সাফ করে ফেললে এই পাহাড় থাকবে? আর পাহাড় না থাকলে আমরা যাবো কোথায় বলো? এবার আপ্যায়াং ফুলুমাকে বললো,
– তোমরা তো পাহাড়ের উঁচুতে থাকতে পারো, তা না করে তোমরা মানুষের পাড়ায় ঢুকে মানুষের সর্বনাশ করো কেন? আমরা মানুষ, পাহাড়ের গায়ে চাষাবাদ করে খাই। সেখানে পাহাড় ধ্বংস হলে তো আমাদেরই ক্ষতি হবে। তাই আমরা সেখানেই চাষ করে খাই, যেখানে পাহাড় কিংবা জঙ্গলের কোন ক্ষতি না হয়। তাই বলে সারা দুনিয়া তুমি জঙ্গল বানিয়ে দেবে নাকি?
এবার আপ্যায়াং এর কথা শুনে যুলুমা খুব কাতর হয়ে বললো,
-আমি তোমার জুম ফিরিয়ে দিচ্ছি, তুমি আমায় জানে মেরো না।
আপ্যায়াং বললো,
-আগে জুম বানিয়ে দাও।
সাথে সাথে ফুলুমা জুম বানিয়ে দিলো আর কাঁদতে কাঁদতে বললো,
– এবার আমার ছেড়ে দাও।
আপ্যায়াং যেই না ফুলুমার মুখের সামনে থেকে ন-না-খাগ সরিয়েছে অমনি ফুলুমা তার পূর্বস্বভাবে ফিরে এলো,
– তবে রে মানুষের বাচ্চা, তোকে খাবো, তোর চৌদ্দগুষ্টি খাবো আর সারা দুনিয়া জঙ্গল বানিয়ে দেবো, যাতে দুনিয়ার কোথাও আর মানুষ বাস করতে না পারে। দুনিয়া জুড়ে শুধু থাকবে ফুলু আর ফুলুমা ।
আপ্যায়াং দেখলো, এই ফুলুমা অতি চতুর। এতোক্ষণ সে ভালো সেজে ছিলো ন-না-খাগ এর ভয়ে। সে সুযোগ পেলেই মানুষের ক্ষতি করবে। আর দেরি করার সুযোগ নেই। এক্ষুণি এই ফুলুমাকে কতল করতে হবে, নয়তো ফুলুমাই তাকে খেয়ে ফেলবে। সে এক মুহূর্ত দেরি করলো না। সাথে সাথে ঘাড়ে ঠেকানো দেগ্রী তুলে সজোরে এক কোপ বসিয়ে দিলো ফুলুমার ঘাড়ে। সাথে সাথে ফুলুমার মাথাটা আলাদা হয়ে দূরে গিয়ে পড়লো। ফুলুমার রক্তে পুরোপুরি গোসল করে উঠলো আপ্যায়াং।
পরদিন এই খবর সারা গ্রামে ছড়িয়ে পরলো। গ্রামবাসীরা এক এক করে ছুটে এলো ফুলুমার মরা দেহ দেখতে। ফুলুমাকে মরে পড়ে থাকতে দেখে সকলেই আপ্যায়াংয়ের নামে জয়ধানি করতে লাগলো। কেননা এতোকাল এই ফুলুমার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল আমবাসী। কখনো ছাগলটা, কখনো গরুটা, আবার কখনো ছোট বাচ্চাকেও এই ফুলুমা ধরে নিয়ে গেছে। ভয়ে কেউ জঙ্গলে ঢুকে চাষাবাদ করতে পারতো না। এই ফুলুমাকে কেউ মারতে পারে এটা যেন তাদের বিশ্বাসই হচ্ছিলো না। আপ্যায়াংয়ের সাহস দেখে সকলেই তাকে অতি সম্মান করতে লাগলো এবং গ্রামবাসীরা সকলে একত্রিত হয়ে আপ্যায়াংকে সেই গ্রামের রাজা বানিয়ে দিলো। রাজকন্যা হলো সেই গ্রামের রাণী। অনেককাল পরে তারা তাদের গ্রামেও একজন সাহসী রাজা আর রূপবতী-গুণবতী রাণী পেয়ে সকলেই সুখে শান্তিতে বসবাস করতে লাগলো।
টীকাঃ
আপ্যায়াং– অলস ।। বিঃশং পোয়েঃ– জল উৎসব ।। য়াকু সেঃ– বাঁশের তৈরি পাহাড়িদের এক প্রকার মাছ ধরার জাল
দুঃলা– বাঁশের তৈরি মাছ রাখার ঝুড়ি।। ফুলু– রাক্ষস।। ফুলুনা–রাক্ষসী।। ফ্রু– সজারু।। দেগ্রী– বড় দা।। ন–না–খাগ– আতা গাছের ডাল
“আপ্যায়াং য়া খোওয়াই, তঁহ বং বং/সইকাঃ ওয়াঃগা, এং সং থং”- (আলসে কেটেছে জুম, বন হয়েছে উধাও গাছপালা সব আগের মতো খাড়া হয়ে যাও)
সংগ্রাহক – অং মারমা